প্রত্যেক সুস্থ ও পরিনত মানুষের একটি পেশা থাকে, যে পেশার মাধ্যমে সে তার জীবন- জীবিকা নির্বাহ করে।সাথে সাথে প্রত্যেক পেশার মানুষের তার পেশাগত আত্মতৃপ্তি থাকে, যে আত্মতৃপ্তি তাকে গর্বিত করে, আনন্দিত করে ও পেশাগত সার্থকতায় নিজেকে ধন্যবোধ করে। তেমনি পেশাগত আত্ম-তৃপ্তির উপলব্ধি থেকে আমার এই গল্প:
আব্দুল্লাহ সাহেব পেশাগত জীবনে একজন ইঞ্জিনিয়ার, এক মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে তার সুখের সংসার।হঠাৎ করে বড় অসময়ে তার স্ত্রী হাসিনা বানু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তখন বড় মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে পড়েন। এবং দুই ছেলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তখন থেকে বড় মেয়ে সংসারের হাল ধরেন, ছোট ভাই দুটিকে মাতৃস্নেহে ও সর্বোচ্চ তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করিয়ে পর্যায়ক্রমে ও লেভেল এ লেভেল পাস করান।ভাই দুটি অত্যন্ত মেধাবী তারা বিদেশী স্কলারশিপে পর্যায়ক্রমে কানাডায় চলে যান। ওখানে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন।আব্দুল্লাহ সাহেব ও তার বড় মেয়ে সকিনা আক্তার বড় ছেলের বিয়ের জন্য আমাদের কাছে আসেন। সেই সময় থেকেই আব্দুল্লাহ সাহেবের সাথে আমার পরিচয়।এক পর্যায়ে বড় ছেলেকে এক সেক্রেটারি সাহেবের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেই। এর কিছুদিন পরে ছোট ছেলের বিয়ের জন্য আসে এবং কয়েক মাসের মধ্যে তার জন্য ও আমরা সুন্দর একটি বিয়ের ব্যবস্থা করি।তখন আব্দুল্লাহ সাহেব কে -আমি তার বড় মেয়ের বিয়ের কথা বলি, তখন বড় মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি অনার্স এম এস সি পাশ করে একটি বড় কলেজের লেকচারার হিসেবে জয়েন্ট করেছেন।কিন্তু কেন যেন উনি একটু এড়িয়ে যান। প্রাণভরে দোয়া করব আপনি অনেক ভাল থাকবেন
যাহোক, এরপরও বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে- বড় মেয়েটার বয়স এখন ৩৮ বছর।হঠাৎ একদিন দুপুরের ক্লান্ত সময়ে ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল ওপাশ থেকে আব্দুল্লাহ সাহেব কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল ভাই, আমি ভীষণ অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। আমাকে একটু দেখতে আসবেন। বিলম্ব না করে সেই দুপুরে উনাকে দেখতে গেলাম। যেয়ে দেখি আব্দুল্লাহ সাহেব- ভীষণ অসুস্থ, রীতিমতো ভাবে শয্যাশায়ী ও মুমূর্ষু। মেয়েটি বাবার পাশে বসে কি যেন চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আব্দুল্লাহ সাহেব আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন- আর বলতে লাগলেন, ভাই- আপনি অনেক বলেছেন কিন্তু আমি শুনি নাই,আমার ছেলেদের কথা ও পরিবারের কথা চিন্তা করে। আজ এই মুমুর্ষ অবস্থায় মনে হচ্ছে আমি বড় অপরাধি,আমি মরে গেলে আমার মেয়েটির কি হবে?
যাহোক আব্দুল্লাহ সাহেব কে শান্তনা দিয়ে বাসা থেকে বের হলাম, পথে এসে চিন্তা করতে থাকলাম ৩৮ বছর বয়সী ও উচ্চশিক্ষিত এই মেয়েকে কার সাথে বিয়ে দেয়া যায়। হঠাৎ করে এটি তো কোনো সহজ কাজ ও নয়। এভাবে দুই থেকে তিন দিন কেটে গেল, হঠাৎ মোবাইলে একটি ফোন পেলাম মাছুম বিল্লাহ ভাইয়ের, যিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স মাস্টার্স করে কানাডায় এমএস ও পিএইচডি শেষ করেছেন। এখন কানাডাতে অনেক বড় চাকরি করেন ওখনে বাড়ি ও কিনেছেন। মাছুম বিল্লাহ ভাইয়ের ছোট বোন -নাজমুন্নাহার কে আরো দুই- তিন বছর আগে বিয়ে দিয়েছিলাম। মাসুম বিল্লাহ ভাই বলল -ভাই, এখন অফিস কি ওই আগের জায়গায় আছে? আমি একটু আসবো। আমি উত্তরে বললাম -আসেন আমি অফিসে আছি। কিছু সময় পরে মাসুম বিল্লা ভাই আসলেন, বললেন ভাই মা ভীষন ধরেছে এবার বিয়ে করে যেতে হবে, জিজ্ঞেস করলম- ভাই, আনার বয়স এখন কত? লল-এখন বয়স আমার ৪২ বছর। আর বিলম্ব না করেই, আব্দুল্লাহ সাহেবের মেয়ে রোজিনা আক্তার এর কথা বললাম এবং বললাম চলেন ভাই -মেয়েটিকে আমরা দেখে আসি, কথামতো দুইজন রিক্সা নিয়ে ওদের বাসায় চলে গেলাম। যেয়ে আব্দুল্লাহ সাহেব কে দেখলাম কঙ্কালসার একটি মানুষ বিছানায় শুয়ে আছে ,পাশে যেয়ে বসলাম। মেয়েটি আর ছেলেটিকে ওদের কথা বলার জন্য সুব্যবস্থা করে দিলাম। চা খেলাম কিছু সময় কাটালাম, এরপরে ছেলেটা কি নিয়ে বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলাম -মাসুম ভাই, মেয়েটি কেমন লাগলো? মাসুম ভাই বলল -ভালো মেয়ে, আমি বললাম আপনার পছন্দ হয়েছে? উনি বললো- হ্যা ভাই আমার পছন্দ হয়েছে।ওনাদের সাথে আলাপ করেন।আমি উনাদের সাথে বলতে মেয়েটির সাথে কথা বললাম।মেয়েটি বলল -আঙ্কেল,ছেলেটি আমার পছন্দ হয়েছে। সেই মোতাবেক কানাডাতে খবর নেয়া হলো, কানাডার থেকে খুব ভালো রিপোর্ট পাওয়া গেল,এক সপ্তাহের মধ্যে মাছুম বিল্লাহ ও সখিনা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়েতে আব্দুল্লাহ সাহেব মৃত্যুপথযাত্রী শয্যাশায়ী একজন মানুষ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিয়ের সমস্ত কার্যকলাপ দেখা-শুনা করলেন চরম দৃঢ়তার ও আনন্দের সাথে। বিয়ের শেষে আমাকে দেখে হাত ধরে কেঁদে দিয়ে বললেন- ভাই, আপনার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। আপনি আমাকে বাঁচালেন, আল্লাহ আপনার ভালো করবে। এইভাবে সবিনা আক্তার ও মাসুম বিল্লার বিয়ে সম্পন্ন হলো। কিছুদিন পরে তারা কানাডায় চলে গেলন, শুনেছি তরা ভীষন সুখে -শান্তিতে বসবাস করছে। এদিকে আব্দুল্লাহ সাহেব এখন মসজিদে যেয়ে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামজ পড়েন,মাঝে-মাঝে তাবলীগে যান, দু এক দিন পর পর আমাদের অফিসে পুরি ও সিঙ্গারা কিনে নিয়ে আসেন।আমার স্টাফদের সাথে গল্প করেন হাসি-তামাশা ঠাট্টা করেন। মনে হয় -এই লোকটি পুনরায় জীবন লাভ করেছেন, তার সেই বার্ধক্য জনিত সমস্যাসহ সব সমস্যা যেন চলে গেছে, নতুন করে জন্ম নিয়েছেন সুখী-সমৃদ্ধ একজন মানুষ।ওনাকে দেখে ভালো লাগে, নিজের কাছে।মনে হয় -যেন পেশাগত সলতা একেই বলে।